IQNA

রোহিঙ্গা গণহত্যায় অভিযুক্ত হতে যাচ্ছেন সুচি

23:34 - December 18, 2017
সংবাদ: 2604590
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার জেইদ রাদ আল হুসেইন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন রোহিঙ্গাদের ওপর যে বিভীষিকাময় নির্যাতন চালানো হয়েছে তার জন্যে দায়ী ব্যক্তিদের বিচার একদিন হবেই।

রোহিঙ্গা গণহত্যায় অভিযুক্ত হতে যাচ্ছেন সুচি

 
বার্তা সংস্থা ইকনা: আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটির মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান তিনি। তার অর্থ সারা বিশ্বের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর নজরদারি রাখার দায়িত্ব তার উপর। ফলে তার এই কথার একটা ওজন তো অবশ্যই আছে, বলছেন, বিবিসির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সংবাদদাতা জাস্টিন রোল্যাট।
তিনি বলেন, এই অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন দেশটির একেবারে শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও- তাদের মধ্যে রাজনৈতিক নেত্রী অং সান সুচি যেমন আছেন, তেমনি আছেন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল অং মি হাইংও।
জাস্টিন রোল্যাট বলছেন, গণহত্যার অভিযোগে তাদেরকেও যে ভবিষ্যতের কোনো এক সময়ে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে- এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এ মাসের শুরুর দিকে আল হুসেইন জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে বলেছেন, মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপরে যে ব্যাপক ও পরিকল্পিতভাবে নিপীড়ন চালানো হয়েছে সেটাকে গণহত্যা হিসেবেও বিবেচনা করা হতে পারে।
জেইদ রাদ আল হুসেইন বলেছিলেন যে মাত্রায় সামরিক অভিযান চালানো হয়েছে সেটাকে গণহত্যা বলা হবে কিনা এ ব্যাপারে একেবারে শীর্ষ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
জাস্টিন রোল্যাট বলছেন, কোনটা গণহত্যা আর কোনটা গণহত্যা নয় তা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়। এটা শুনতেও ভয়াবহ কারণ এটা হচ্ছে 'অপরাধেরও অপরাধ।' এবং এ পর্যন্ত এই গণহত্যার অভিযোগে খুব কম সংখ্যক লোকেরই সাজা হয়েছে।
গণহত্যাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হলোকাস্ট বা হত্যাযজ্ঞের পর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গঠিত
জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোও এই গণহত্যার ব্যাপারে একটি সনদে স্বাক্ষর করেছে। যেখানে গণহত্যা বলতে বোঝানো হয়েছে- কোনো বিশেষ একটি জনগোষ্ঠীকে নিধন করার লক্ষ্যে তাদের ওপর নিপীড়ন চালানো।
জাস্টিন রোল্যাট বলছেন, মিয়ানমারে গণহত্যা চালানো হয়েছে কিনা সেটা প্রমাণ করা জেইদ রাদ আল হুসেইনের কাজ নয়। একমাত্র আদালতই এই কাজটি করতে পারে।
তবে এ বিষয়ে তিনি আন্তর্জাতিক তদন্তের আহবান জানিয়েছেন। এটা করতে গিয়ে তিনি মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে মুসলিম রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর ওপর হামলাকে 'জঘন্য ও বর্বর' বলে উল্লেখ করেছেন।
তবে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার স্বীকার করেছেন এটাকে গণহত্যা হিসেবে তুলে ধরার কাজটাও খুব একটা সহজ হবে না। কারণ কেউ যখন গণহত্যার মতো অপরাধের পরিকল্পনা করে সেটা তো আর কাগজে কলমে করা হয় না।
তবে তিনি বলেছেন, এটা প্রমাণ করার জন্যে অনেক কিছুই আছে। ফলে আজ আমরা যা কিছু দেখতে পাচ্ছি সেখান থেকে ভবিষ্যতে আদালত এ বিষয়ে তথ্য প্রমাণ বের করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
গত অগাস্ট মাসে নির্যাতন নিপীড়ন শুরু হওয়ার পর থেকে এই ডিসেম্বরের মধ্যেই সাড়ে ছয় লাখের মতো রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে, যা মোট রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুই তৃতীয়াংশের মতো।
এছাড়াও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শত শত গ্রাম এবং কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে।
যে ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হচ্ছে তার তথ্য প্রমাণ রয়েছে। যেমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড, খুন, গণহারে ধর্ষণ- এসব অভিযোগ পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের মুখ থেকেই এসেছে।
বলা হচ্ছে, অগাস্ট মাসে নিপীড়ন শুরু হওয়ার ছয় মাস আগে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচিকে আহবান জানিয়েছিলেন রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্যে।
জেইদ রাদ আল হুসেইন বলেছেন, ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে যে সহিংসতা শুরু হয়েছিল তার উপর এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন প্রকাশের সময় তিনি টেলিফোনে অং সান সুচির সাথে কথা বলেছিলেন।
আল হুসেইন বলেছেন, সামরিক বাহিনীর অভিযান বন্ধ করার জন্যে আমি তার প্রতি আহবান জানিয়েছিলাম। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথেই বলতে হচ্ছে যে, এরকম কিছু হয়নি।
সেনাবাহিনীর উপর সুচির ক্ষমতাও খুব সীমিত। তবে জেই; রাদ আল হুসেইন বিশ্বাস করেন যে চেষ্টা করলে হয়তো তিনি কিছু একটা করতে পারতেন।
সুচি রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ না করাতেও আল হুসেইন মিয়ানমারের নেত্রীর সমালোচনা করেছেন।
জাতিসংঘের এই কর্মকর্তা মনে করেন, ২০১৬ সালের সহিংসতার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয় তখনই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সাহস বেড়ে যায়। আমার মনে হয় তখন তারা ধরে নেন যে, তারা যেটা করছিলেন কোনো ধরনের ভয়ভীতি ছাড়াই তারা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেন, বলেন তিনি।
তবে শুরু থেকেই আমরা অনুমান করতে পারছিলাম যে সবকিছু চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা করেই করা হচ্ছে।
মিয়ানমার সরকার বলছে অগাস্ট মাসে তাদের নিরাপত্তা বাহিনীর উপর সন্ত্রাসী হামলার জবাবেই তারা সেখানে অভিযান চালাতে শুরু করে।
তবে বিবিসির অনুসন্ধানী একটি টিভি অনুষ্ঠানের জন্যে তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখা যায় তার বহু আগে থেকেই এই সেনা অভিযানের পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল।
ওই অনুষ্ঠানে দেখানো হয় যে, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ স্থানীয় বৌদ্ধদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি তাদের কাছে অস্ত্রও সরবরাহ করছিল।
অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থীও বলেছেন, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা কিভাবে তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। মায়ানমারের একজন সফল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রফিক বলেছেন, তারা ঠিক সেনাবাহিনীর মতো, তাদের কাছেও ছিলো একই ধরনের অস্ত্র। তারা স্থানীয় কিছু ছেলে। আমরা তাদেরকে চিনতাম। সেনাবাহিনী যখন আমাদের বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছিল, আমাদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছিল, তখনও তারা সেখানে ছিল।
এছাড়াও রাখাইনের রোহিঙ্গারা খাদ্য সঙ্কটেরও সম্মুখীন হয়েছিল। এই রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে গ্রীষ্মকালে খাদ্য সঙ্কট প্রকট আকার নেয় এবং জানা গেছে, অগাস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ের পর থেকে কর্তৃপক্ষ সেখানে সব ধরনের খাদ্য সাহায্য পাঠানো বন্ধ করে দেয়।
এছাড়াও রাখাইনে আরো প্রচুর সৈন্য মোতায়েন করা হয়। জানা যায় নিরাপত্তা বাহিনীর উপর সন্ত্রাসী হামলার দুই সপ্তাহ আগেই সেখানে এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
তখন মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক দূত সংযম প্রদর্শনের জন্যে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন।
কিন্তু রোহিঙ্গা জঙ্গিরা যখন পুলিশের ৩০টি পোস্টের এবং সেনাবাহিনীর একটি ঘাটির ওপর হামলা চালায়, তখন সামরিক বাহিনী কড়া অভিযান শুরু করে। আর সেটা ছিল পরিকল্পিত ও ভয়াবহ।
এ বিষয়ে বিবিসির পক্ষ থেকে অং সান সুচি এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানের কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিলো। কিন্তু তাদের কেউই বিবিসির প্রশ্নের উত্তর দেননি।
এর চার মাস পরেও সেখানে সহিংসতা চলছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জেই রাদ আল হুসেইন। তিনি আশঙ্কা করছেন, সেখানকার পরিস্থিতি হয়তো আরো অনেক খারাপও হতে পারে।
তার আশঙ্কা হলো বাংলাদেশের শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে এখন জিহাদি গ্রুপের সৃষ্টি হতে পারে, যারা হামলা চালাতে পারে মিয়ানমারের উপর। এমনকি তারা বৌদ্ধদের মন্দিরের উপরেও হামলা চালাতে পারে। তখন বৌদ্ধ আর মুসলমানদের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।
কিন্তু হাই কমিশনার জেইদ রাদ আল হুসেইনের ভয় হচ্ছে যে মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে নিচ্ছে না। আরটিএনএন

 

captcha